top of page

এত রোদ্দুর এদেশে যে বাজরায় হাতে করে গড়া মোটা চাপাটি, যাকে বলে জোলাডা রোটি, দুপুরে পাথরের গায়ে মেলে দিলেও চলে। চলে মানে তাই করে লোকে। এক ঘণ্টার মধ্যে শুকিয়ে ঝনঝনে হয়ে যায়। জ্বালানি বাঁচে। কাজ করতে করতেই দুপুরের খাবার তৈরি হয়ে যায় এরকম করে। কাই বা খাবার, ওই তো রোটি আর এক মুঠো বাদাম, একমুঠো শুকনো লঙ্কা পিষে একটু চাটনি। রাতে কোন কোন দিন তার সঙ্গে তুর ডালের সম্বর কি পুঁইশাকের তরকারি। পল্ল্যা। বেঙ্গন পল্ল্যা কি ভিঙে পল্ল্যা। অন্ন হয় কেবল মুত্তাইদে হুন্নিমের দিন, বড় গোল চাঁদ ওঠে, সেদিন ইয়োলাম্বা কুমকুম পরেন আর চুড়ি। ইয়েলাম্মা সধবা হবার আনন্দে মন্দিরে সেদিন আরতি হয়। অন্ন প্রসাদ হয়। নিজেদের ঘরে ভাত রাঁধে মেয়েরা। মাসে একদিন। বাকি দিনগুলো কাটে ওই রকমই। ছোটো ছেলেদের মন তবু পড়ে থাকে কখন খাওয়া হবে সেইদিকে।

মুখে বলতে ঘরের কাজ, কাজ তো আসলে বাইরের ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে সকাল বেলা ঘরের কাজ বলতে কেবল ঘর থেকে আগের রাত্রের আবর্জনা সব বার করে ফেলে ঘরের দরজা-গোড়া থেকে দু হাত আঙ্গিনাটুকু পরিষ্কার করা। দরজার পাশে যেখানে নিমপাতার গোছা ঝুলিয়ে রাখা আছে তার পাশে হলুদ গুঁড়ো দিয়ে চিহ্ন দেওয়া। ওটি মঙ্গলচিহ্ন। হলুদ বড় পবিত্র জিনিস। হলুদকে তারা বলে ভাণ্ডারা। আগেকার দিনে ভাণ্ডারা লাগিয়ে দিলে মানুষের কাটা মাথা জোড়া লেগে যেত। এখন আর মানুষের মনে বিশ্বাস নেই। জিনিসেরও সেই গুণ নেই। তবু নিয়ম যা তা তো করতেই হবে। সেটুকু হয়ে গেলে এবার ঘরের ভেতরের কাজ শেষ। ছেলেরা দুমুঠো ভাজা জোয়ার না হয়। একমুঠো বাদাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঘরের এক দুটো যা ছাগল, সেগুলোও বেরিয়ে গেল তাদের সঙ্গে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে যেগুলো একেবারে ছোটো, সেগুলো ওই ছাগল চরাবার নামে সারাদিন এই মাঠে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবে। ঝোপঝাড় ভেঙে খুঁজে বীজ ফলপাকুড় যা পাবে খাবে। দুপুর পার হলে একবার মায়ের খোঁজে আসবে চাপাটির জন্য। একটু বড় ছেলেরা, আধবুড়ো লোকেরাও যারা গায়ে আছে, কাজ করে গৌড়াদের খেতে। খেত বলতে তো ওই, খারিফে বাজরা, তুর, আর রবিতে জোয়ার, বাদাম। আজকাল খানিক সূর্যমুখী ফুলেরও চাষ হয়। বৃষ্টি এদেশে নেই বললেই চলে। দক্ষিণে জলে মাটিতে সবুজে সবুজ আর এখানে দ্যাখো, ইয়েলাম্মা আর ক্ষেত্রপালের রাগে ক্রোধে যেন জ্বলে গেছে সমস্তটা।

সেই জ্বলতে থাকা শুকনো মাঠের ওপর দিয়ে মাথার দুটো কল্পে, কাখে বিন্দিগে আর নাহলে দু হাতে দুটো ডোল ঝুলিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকে মেয়েরা। আশপাশে দুই চারটে বাড়িতে নিজেদের কুয়ো আছে কিন্তু তাদের তবু যেতে হবে অনেক অনেক দূর। গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে ক্ষেত, তারও বাইরে একটা পুকুর যাকে তারা বলে 'কেরে' তার জল শুকিয়ে তলায় একটু কাদাকাদা, সেখানেই স্নান, কাপড় ধোয়া। সেই জলই মাথায় করে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরা। কাদা তলায় থিতিয়ে গেলে বিন্দিগে ভরে আলাদা করে রেখে সেই জলই খাওয়া। আর ভয়, কবে এসে দেখবে একেবারে শুকনো পুকুর। জল নিয়ে ফিরবার পথে ক্ষেত্রপালের কাছে মনে মনে এই মিনতি জানাতে কোন মেয়ে ভোলেনা যে হে পরশুরাম, তুমি স্বয়ং ইয়েলাম্মার পুত্র। আমরা ইয়েলাম্মার দাসী, দয়া করে আমাদের পুকুরে জল রেখো।

আর কখনো হয়ত এক দুটো একেবারে হতভাগা গ্রাম থাকে, এই নাগহল্লির মত, যেখানে কোনও উঁচু জাতের গৌড়েদেরে বাড়ি নেই ইয়েলাম্মার মন্দির ছাড়া, একটা কি দুটো মাত্র পাকাবাড়ি। এছাড়া কেবল কতগুলো ছোট ছোট টালি কি পাতা ছাউনির বাড়িতে বাস করে মোটে চল্লিশঘর লোক। তবু তাদের আছে এক সৌভাগ্য। তাদের বাঁশগাছ বাবলাগাছ ঘেরা একটুকরো যে সবুজ সেইখানে রয়ে গেছে বহুকালের পুরানো এক বাভি। লোকে বলে অনেককাল আগে চম্পকী নামে এক দেবদাসীকে গাঁয়ের পাটিল নিজে রেখেছিল এইখানে। পাকা বাভি করে দিয়েছিল। সে নাকি ছিল এমন রূপসী যে তার দিকে সামনাসামনি চোখ তুলে দেখতে সাহস হত না গাঁয়ের কারো। লোকে তাকে দেখত কেবল পেছন দিক থেকে। মন্দিরে যেদিন সে গান গাইত, আরতি করত, পাটিল আর পুরোহিত সারাদিন থাকত সেখানে। সে সব হুন্নিমে উৎসবের সমস্ত খরচ পাটিল নিজে দিত কিংবা দিত বড় বড় এজমানরা। দেবতার দাসিন, সে কোনদিন এক পোশাক এক দুবার পরতো না। তাকে এমন মাথায় করে রেখেছিল পাটিল যে মাঝে মাঝে নিজে এসে বাস করত চম্পকীর বাড়িতে। চোখের আড়াল করতে স্বস্তি পেত না। তখন নিজের জন্য, হয়ত সেই চম্পকীর জন্যেও, জলের ব্যবস্থা করতে বাড়ির উঠোনে বাভি খোঁড়ালো পাটিল। কতকাল গিয়েছে তারপর, কোথায় সেই পাটিল আর কোথায় চম্পাফুলের বরণ সেই চম্বকী। লোকে বলে পাটিল চম্পকীর চেয়েও সুন্দরী এক উনিশ বছরের দেবদাসীকে পেয়েছিল। গুলবর্গায়। । চম্পকীর ও বয়েস বেড়েছিল। কিন্তু তাকে যা কিছু দিয়েছিল, কিছু ফিরে নেয়নি পাটিল। চম্পকীর যে কী হল তারপর সে কথা কে বা জানে। কিন্তু সেই বাড়ি রয়ে গেল। পুরানো ভাঙা, ধারের পাথরগুলো টলটল করে, তবু নাগহল্লিকে খাবার জল যোগায় এই বাড়ি। এই কুয়োটাও দূরে, গ্রামের এক প্রান্ত ঘেঁষে, কিন্তু তবু তো কুয়োর জল। কাপড় কাচা, বাসনধোয়া সব সেই দূরেরই পুকুর থেকে করে আনতে হয়। কিন্তু ওই কাদাজল খেতে হয় না। নাগহল্লির এই ত্রিশ-বত্রিশটা ঘরের লোকেদের। নাগহল্লির মেয়েরা নিজেদের ভাগ্যকে এই একটা কারণে অন্তত ধন্যবাদ দেয়। গ্রামের ছোটরা খুশি হয়। অন্য একটা কারণে। এককালে সেই চম্পকীর বাড়িতে লাগানো ছিল হয়ত, আজও ভাঙাচোরা ধ্বংসস্তূপের আশপাশে গোটা তিনেক আম দুটো প্ৰকাণ্ড নিমগাছ আছে। সারাটা শীতকাল পাকা হলুদ নিমফলের লোভে আর গরম শুরু হবারও আগে থেকে বিষাক্ত সাপ কি বিছের ভয় তুচ্ছ করে গ্রামের বাচ্চাগুলো পড়ে থাকে সেইখানে। ঝরা মুকুল থেকে আমের কুসি পর্যন্ত তুলে চাটনি বেটে জোলাডা রোটির সঙ্গে খাওয়া হয় বলে গাছগুলোয় বড় আম ধরে কিনা সে আর কেউ জানতে পারে না। লুকিয়ে এক্-আধটা টক ফল যদি ধরে সে থাকে কেবল সুগগাদের জন্য। চকচকে সবুজ ডানা মেলে সেই সুন্নারা একদিন সূর্যোদয়ের কালে সেই প্রকাণ্ড গাছের মগডালগুলোয় এসে বসে যদি কোনও ফল সেখানে থাকে তা খেয়ে উড়ে যায়। চেঁচামেচিও করে না এমনকী!

Swarnakumarir Mrityu O Jiban || স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন || Jaya Mitra

SKU: 000297
₹280.00 Regular Price
₹224.00Sale Price
  • Book
    • স্বর্ণকুমারীর মৃত্যু ও জীবন
    Author
    • জয়া মিত্র
    Binding
    • Hardcover
    Publishing Date
    • 2024
    Publisher
    • Suprokash Publisher
    প্রচ্ছদ ও অলংকরণ
    • কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত
    Language
    • Bengali

Related Products

bottom of page