রবীন্দ্র নাথের গানে যেমন পূজা ও প্রেম একাকার হয়ে যায়, তেমনই সুফী দরবেশ নিজেকে আল্লাহের প্রেমে সদা মশগুল হয়ে আত্মোৎসর্গের উন্মাদনায় এগিয়ে চলেন। বৈষ্ণব তত্ত্বে গোপীদের মতই মারফতের সাধকেরাও নিজেদের ঈশ্বরের প্রীতির জন্য উৎসুক হয়ে থাকেন। নিজেদের জন্য তাঁদের কোন আকাঙ্খা থাকে না, ঠিক যেমন বর্ণনা আছে ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ কাব্যে
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তার নাম কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।।
এই আত্মনিবেদন আদতে ধর্মজগতের এক অতি প্রাচীন রীতি। পৃথিবীর সব দেশেই এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ধারা লক্ষ্য করা যায় যেখানে ঈশ্বরকে পাওয়া ও জানার উদ্দেশ্যে সাধক, ভক্ত কৃচ্ছসাধনের পথ বেছে নেন। মর্মবাদী সাধনার পন্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। সুফী শব্দের অন্যতম অর্থ পবিত্রতা। অন্তর ও বাহিরে সকল বিষয়ে যিনি পবিত্র তিনিই সুফী। ইসলামের প্রাথমিক বিস্তার লগ্নে পশমী পোষাক ছিল ত্যাগ, বিলাসবর্জিত অনাড়ম্বর অনাসক্তির প্রতীক। ক্রমে ‘খলিফা-ই-রাশিদীন’ দিন শেষ হয়ে এলে, ইসলামে বিলাসিতা, আড়ম্বর আর সংসারী বিষয়ে আসক্তির প্রাবল্য ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে। একদল সাধক, তাঁরা অবশ্যই সংখ্যায় নগণ্য, প্রত্যক্ষভাবে কোনো সংঘাত বা বিরোধিতায় অবতীর্ণ না হয়েই নির্জনে এমন জীবন চর্যায় আত্মনিয়োগ করলেন যা আদর্শ বলে বহুজনের কাছেই স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। আদতে এক মর্মমুখী শক্তিকে কর্মমুখী শক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রকল্প নিয়েছিলেন সুফী সাধকেরা। যদিও ইসলাম কখনও বৈরাগ্য ও ভাবাবেশের দিকটিকে অতিরিক্ত প্রশয় দেয় নি, তবুও সুফীদের ভাবনায় আল্লাহের পথে এগিয়ে যেতে ত্যাগের মহিমা স্বীকার করে নেওয়া জরুরি বলেই মনে করা হত। সুফীরা বলেন হজরত মহম্মদ প্রচারিত ধর্মের বাহ্যিক আচার ব্যবহার ও নিয়ম কানুন ছাড়াও এক গুপ্তজ্ঞানের দিকও ছিল। বাহ্যিক বা ‘জাহির’ আর গুপ্তজ্ঞান বা ‘বাতুন’ এই দুই ধারাই হজরত মহম্মদ অতীব যত্ন সহকারে রক্ষা করে চলতেন। সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির কথা বারবার প্রচার করে গেলেও ঐ গুপ্তজ্ঞানের দিকটিও লুপ্ত হয়ে যেতে দেন নি। তাঁর বাণী সম্বলিত কোরানের সকল আয়াতের মধ্যে বিশেষ এমন কয়েকটি আয়াতের সন্ধান মেলে যার মধ্যে দিয়ে মর্মবাদের মর্মবাণী প্রকাশ পায়। হজরতের লৌকিক শিক্ষা আর গুপ্তজ্ঞানের বিষয় দুটি ভিন্ন। সুফীরা সেই গুপ্তজ্ঞানের পথটিকেই বেছে নেন। ক্রমে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের চরমসীমায় উত্তীর্ণ হয়ে যান তাঁরা। সেই স্তরে অদৃশ্য আর দৃশ্য বস্তুর মধ্যে, সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যেকার সকল প্রভেদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। গভীর সেই প্রজ্ঞার অবস্থায় সনাতন ধর্মের মর্মস্থল থেকে উচ্চারিত হয় ‘ সোহম’, আর সুফী সাধকেরা বলে ওঠেন, ‘অনা-ল-হক্ক’, আমিই সেই।
Reviews and Ratings
PIRKATHA | পিরকথা
Type of Product Physical Authors Koushik Dutta Publisher list Khori Prakashani Languages Bengali Binding Hardbound Publishing Year 2022