এই বইটিতে মোট ১৬ টি গল্প আছে। যা হলো~
১) প্রায়শ্চিত্ত~ পাপের প্রায়শ্চিত্ত সবাইকেই করতে হয়, সে পাপ জেনেশুনেই হোক বা অজান্তেই হোক না কেন। আর এই পাপ বা অপরাধের বোঝা বহন করা খুবই কঠিন। বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক কামরুল সাহেব নিজের অফিসে বসে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার কথাই ভাবছিলেন। কারণ তিনদিন আগে এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। কিন্তু কী পাপ তিনি করলেন আর তার প্রায়শ্চিত্তই বা তিনি কীভাবে করবেন?
২) একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা~ গাব গাছের কোটরে বসে একাকীত্ব কাটাতে খুব ভালো লাগে দশ বছরের জয়নালের। কিন্তু হঠাৎ একদিন এই গাব গাছের কোটর থেকে ঘুম ভাঙা চোখে বাইরে এসে সে দেখে গ্রাম জনমানবশূন্য। কোথায় গেল তার বাবা-মা, গ্রামের সকল লোক? মায়ের জন্য আনা নতুন শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সে খুঁজতে থাকে তার বাবা-মাকে। কিন্তু আপনজনকে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ কামরাঙা বোমা নিয়ে সে কেন ঝাঁপিয়ে পড়ল?
৩) ছোঁয়া~ বৃদ্ধ বয়সে এসে মালতী দাস লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু এই বয়সে এসে লেখাপড়া শেখার কারণ বুঝতে পারে না কেউই। এ কি শুধুই তার নিজের ভাষা জানার আগ্রহ নাকি এর পেছনে রয়েছে কোন মর্মস্পর্শী অতীত?
৪) উপহার~ কালামমিয়া ও সেলিনা বেগমের সন্তান আলাল, আর পাঁচটা বাচ্চাদের মতো সুস্থ-স্বাভাবিক নয়। আঠারো বছর বয়সে এসে সে শুধু 'মা আক্কা' কথাটাই বলতে পেরেছে। তবে সেলিনার এতে দুঃখ নেই। কিন্তু চিন্তার বিষয় ছেলে বড়ো হচ্ছে, তাই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে এবার ভাবনা বাড়ছে। সেই চিন্তার তাড়নায় কালামমিয়ার কাজের যায়গাতেই সেলিনাও কাজ নিল, যাতে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। সবই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু অকস্মাৎ ঘটে গেল এক ভয়াবহ ঘটনা। গল্পের শেষটা পুরো স্তব্ধ করে দিল।
৫) সুখের মণি~ সামান্য সুখের হাতছানি পেতে না পেতেই মানুষ স্বপ্ন দেখা শুরু করে। দীর্ঘদিনের না পাওয়াগুলোকে এবার পূরণ করার স্বপ্ন সে দেখে। কিন্তু সব স্বপ্ন সবসময় পূরণ হয় না। হয়তো না হওয়াই ভালো। কারণ কিছু স্বপ্ন যে দুঃস্বপ্নও হয়। এই গল্প সেইদিকেই ইঙ্গিত করে।
৬) ভুল সাক্ষাৎ~ নিষিদ্ধ পল্লিতে নানারকম মানুষের আসা যাওয়া। এরকমই একদিন মনোয়ারার সামনে এক অল্প বয়সি ছেলে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ভালো খদ্দের হওয়ার পরও সে সেই ছেলেটিকে তাড়িয়ে দেয়। ছেলেটিকে তাড়িয়ে দিয়ে কোন স্মৃতি হাতরাতে থাকে সে?
৭) অধর্ম~ মোতালেব মিয়ার ইচ্ছে হজে যাওয়ার একদিন। হজে যাওয়ার অর্থ জোগাড় করার জন্য সে তার ছেলের তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ফেলে আসা এক অতীত হঠাৎই তার সামন এসে দাঁড়ায়। কোন পথে এগোবে সে এরপর?
৮) হয়তো~ হরিপুর গ্রামে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে, যেটি প্রতি অমাবস্যার রাতে নাকি কাঁদে। গল্পকথকের এইসব অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ে বিশ্বাস নেই। তবুও সে সত্যিটা জানার জন্য এবং কিছুটা আগ্রহ থেকেই সেখানকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। এরপর গল্পকথকের সাথে সাথে আমরাও জানতে পারি কিছু অজানা কাহিনী। এই গল্পটা এক জায়গায় যেমন বেশ হাসালো, তেমনই আরেক জায়গায় মন খারাপ করে দিল।
৯) অ-সুখ~ অসুস্থ স্বামী খালেদের দীর্ঘদিন সেবা শুশ্রূষা করতে করতে লোপার মনটা বিষিয়ে গেছে। সে হাসতে ভুলে গেছে, কারোর সাথে ভালোভাবে কথা বলতে পারে না, কাউকে সুখে থাকতে দেখলে তার গা জ্বলে ওঠে। কিন্তু রত্না আপার আগমনে সে উপলব্ধি করে তার মুক্তির প্রয়োজন। খুঁজে নেয় সে নিজের মুক্তির পথ।
১০) আংটি~ বেকার স্বামীর সব আবদার মেটাতে গিয়ে রুমালি আজ প্রায় নিঃস্ব। শেষ সম্বল বলতে শুধু এখন একটি সোনার আংটি। কিন্তু প্রিয় মানুষের দেওয়া আংটিটা সে হারাতে চায় না। তাই সে বেছে নিল অন্য পন্থা। কী সেই পন্থা?
১১) ফ্যাকাশে লাল ফুল~ দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া কুসুমদের এতোটাই অভাব যে তার একটা জামা অবধি নেই। যাও একটা আছে, তা জোটে কেবল ঈদের সময় বা শীতকালে। তবে সময়ের সাথে সাথে সে উপলব্ধি করে তার সত্যিই একটা জামার খুব দরকার। কিন্তু হঠাৎই একটি দুঃস্বপ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। এক নিমেষেই চোখের সামনে সব পাল্টে যায় তার।
১২) রমজান~ পাঁচ বছর বয়সে রমজানকে তার বাবা চায়ের দোকানের কাজে লাগিয়ে দেয়। তবে কিছুদিন পর সেখান থেকে পালিয়ে সে ভিক্ষা শুরু করে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভিক্ষার থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ কমতে থাকে। হিংসা হয় তার সেইসব ভিক্ষুকদের দেখে যাদের এক পা নেই। সে ভাবে তারও যদি একটা পা না থাকতো তাহলে ভিক্ষা চাওয়াটা কত সহজ হত। কত সুখের হাতছানিই না সে পেত। একজন ভিখারীর জীবন যে কতটা কষ্টের হয় এই গল্পটা তা বুঝিয়ে দিল।
১৩) চশমা~ অতীত অনেকেরই থাকে। পথ চলতে গিয়ে অনেক সময় সেই অতীতের সম্মুখীন হয়ে যেতে হয়। তখন সেই অতীত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ঠিক যেমন এই গল্পে প্রাক্তন প্রেমিকাকে দেখে প্রাক্তন প্রেমিক সেই অতীতের স্মৃতিতে ভেসে যায়। আসলে ভুলতে চাইলেও, অতীতকে সবসময় ভোলা যায় না।
১৪) নিমকহারাম~ নসিব মিয়ার দুটো হাড়গিলে গরু রয়েছে। এই গরুদুটোয় টানা গাড়ি থেকে করা উপার্জন থেকে তার সংসার চললেও তাদের উপর অত্যাচার করতে তার হাত কাঁপে না। কথায় আছে না, তোমার কর্মের ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে। পাপ কারলে তার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। নসিব মিয়ার ভাগ্য তাকে সেখানেই এনে দাঁড় করায়।
১৫) বুড়ো দাঁড়কাক মরেনি~ অতীতের সেই বেলী পাগলিকে আজ বহু বছর পর পাঁড় তার পাড়ার রাস্তায় দেখতে পেল। অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার। কিনে আনে সে ওই বৃদ্ধার জন্য একটি শাড়ি। যদিও অতীতের আর আজকের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা।
১৬) বিসর্জন~ বৃদ্ধ লক্ষণকে ফেলে রেখে পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য তার সন্তানরা পালিয়ে যায়। সে নিজেও প্রাণে বাঁচার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে তার ছাগলটাকে নিয়ে। এদিকে গ্রাম ছাড়ার পর মাঝপথে সে জ্ঞান হারায়, আর তখন কিশোরী দুর্গা সেবা যত্ন করে তাকে সুস্থ করে তোলে। কিন্তু লক্ষণ চিরকাল নিজের কথা ভেবে এসেছে। সে কি পারবে নিজেকে পরিবর্তন করতে?
ওবায়েদ হক, শুধু এই নামটাই যথেষ্ট। বইয়ের বিষয়বস্তু কী, তা আমি আগে চোখ বুলিয়েও দেখি না। কারণ ওই একই, প্রিয় লেখক, তাই নামটাই যথেষ্ট। 'তেইল্যা চোরা' বাদ দিয়ে ওঁর বাকি বইগুলো কোনো বিষয়বস্তু না জেনেই কিনেছিলাম, আর পড়ার পর ভেসে গিয়েছিলাম। এই বইটিও যখন কেনার কথা ভেবেছিলাম, তখনও জানতাম না এর বিষয়বস্তু কী। কেনার সময় জানলাম এটি গল্প সংকলন। ছোটোগল্প লেখা অতো সহজ না, সবার লেখা মন ছুঁতে পারে না। তবে ওবায়েদ হক এক্ষেত্রে আলাদা। ওঁর লেখায় একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করে, পুরো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এই বইয়ের মোট ১৬টি গল্প, প্রত্যেকটি গল্পেরই বিষয়বস্তু আলাদা। একটার সাথে আরেকটার কোনো মিল নেই, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের। গল্পগুলো পড়তে গিয়ে কখনও হেসেছি, কখনও মর্মাহত হয়েছি, কখনও চোখের পাতা আর্দ্র হয়েছে, আবার কখনও ঘৃণায় ভরে গেছে মন। সত্যি বলতে একসাথে পাঠককে হাসাতে, কাঁদাতে আবার ঘৃণা ধরাতে সবাই পারে না। আর এইজন্যই তিনি আলাদা। অল্প পরিসরের মধ্যে যেভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখের কাহিনী ফুটিয়ে তুলে পাঠক মনে ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছেন, তারজন্য তাঁকে আবারও কুর্নিশ জানাই।
কোনোবারই আমি ওঁর লেখার খুঁত ধরতে পারি না। এইবারও পারলাম না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধু পড়েই গেলাম। ওঁর লেখা উপন্যাসের মতো এই ছোটোগল্প সংকলনেও বরাবরের মতো বিষণ্ণতার ছোঁয়া ছিল, কিন্তু তবুও প্রত্যেকটি গল্প সুন্দর ছিল। যে গভীরতা নিয়ে গল্পগুলো লেখা, তা খুব ভালোভাবেই উপভোগ করেছি। যারা ছোটোগল্প পড়তে ভালোবাসেন বা ওঁর লেখা পড়েছেন, তাদের বলবো এই বইটা একবার পড়ে দেখতে পারেন। ভালো লাগবে। পাঠে থাকুন।
সবশেষে এটাই বলবো, আমি আবারও 'একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা' নিয়ে 'জলেশ্বরী'তে নৌকা ভাসিয়ে 'নীলপাহাড়' হয়ে 'কাঙাল সংঘ'এ ফিরতে চাই 'তেইল্যা চোরা'র সাথে সাক্ষাৎ করে।
Ekti Shari O Kamrang Boma || একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা || Obayed Haque
Book - একটি শাড়ি ও কামরাঙা বোমা
Author - ওবায়েদ হক
Binding - Hardcover
Publishing Date - 2021
Publisher - অরণ্যমন প্রকাশনী
প্রচ্ছদশিল্পী Language - Bengali