top of page

জীবনে কিছু কিছু ঘটনা কাকতালীয় ভাবে ঘটে যায়। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে সেই সময় ঘটনাটা নেহাত সাধারণ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এখন আমি দুভাবে বিশ্বাস করি, এই ঘটনাগুলোর পিছনে অতিলৌকিক যোগাযোগ আছে। আজ মনে হয়, সে দিন যদি আমি হজরতগঞ্জে না যেতাম, লখনউ আমার চোখে কোনোদিনই ধরা দিত না। বাস্কেট চাট খেয়ে ঘোরাঘুরি করছি, এমন সময় আমার চোখে পড়ল মেফেয়ারের সামনে অবস্থিত একটা বইয়ের দোকানের উপর। ব্যস! আমি অন্যদের নজর এড়িয়ে টুক করে সেই বইয়ের দোকানে সেঁধিয়ে গেলাম।

ছোট্ট দোকান। সেগুন কাঠের তাকে সার সার বই, বেশিরভাগই ইংরেজি। সাবেকি আমলের কয়েকটা চেয়ার এদিক-সেদিক রাখা, সেখানেও বইবোঝাই করা আছে। কয়েকজন নিমগ্ন হয়ে বইয়ের তাকের মাঝের গলিতে বসে বই পড়ছে। আন্তরিক পরিবেশ, উষ্ণ আবহাওয়া। কাউন্টারে বসে এক বৃদ্ধ মাঝবয়সী এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করছিলেন। তার পরনে বাদামি রঙের সোয়েটার, হাতে চা, কাউন্টারের উপর রাখা চায়ের ফ্লাস্ক। আমাকে দেখেই যেন কতদিন ধরে চেনেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, 'আইয়ে! চায় পিজিয়ে !' আমি আপত্তি করার আগেই ভদ্রলোক ফ্লাস্ক থেকে চা বের করে একটা খুরিতে ঢেলে এগিয়ে ধরলেন। হাসিমুখে বললেন, 'শর্মাজি কি চায় কোই না নেহি কেহতে!'

ইতস্তত ভাবে চায়ে চুমুক দিয়েই আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। এমন চা আগে খাইনি। অতুলনীয় স্বাদ তো বটেই, একটা নিজস্বতাও আছে। আমার সময় নিয়ে চা খাওয়া অভ্যেস, এক চুমুকে চা খেয়ে ফেললে ঠিক মেজাজ আসে না। কিন্তু লোভে পড়ে সেদিন। কয়েক চুমুকেই চাটা শেষ করে ফেললাম। কাউন্টারের ভদ্রলোক কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে লক্ষ করছিলেন। নিঃশব্দে আরেক ভাঁড় চা এগিয়ে দিয়ে, কী বই চাই না চাই সেই প্রসঙ্গ একবারের জন্যও না তুলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'কেয়া করতে হ্যায় আপ? '

ভদ্রলোকের বয়স কম করেও সত্তর-পঁচাত্তর হবে। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, 'আমাকে তুমিই বলুন। আমি অনেক ছোটো।

দু'জনেই সোচ্চারে হেসে উঠলেন। মাঝবয়সী ভদ্রলোক বললেন, 'জনাব, আপ লখনউ মে হ্যায়। তেহজীব অউর অদব সে লবারেজ হ্যায় ইয়ে শহর, হুমে পহলি মুলাকাত মে তুম কহনে কী ইজাজত নহি।'

কথাবার্তা জমে উঠল কিছুক্ষণে মধ্যেই। একসময় জিজ্ঞেস করলাম, 'এখানে টুন্ডে কাবাব ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না?'

একজন আশ্চর্য হয়ে বললেন, 'সে কী জনাব! আপনি পুরোনো লখনউতে যাননি নাকি ?' আমি একটু লজ্জিত হয়ে বললাম, 'খুব একটা যাওয়া হয়নি। তবে দু-একবার গিয়ে দেখেছি, বিশেষ কিছু পাইনি।'

কথাটা শুনে বৃদ্ধ কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের মনে বললেন—

'মুঝসে সুবহো-শাম শিকওয়া কর রহা হ্যায় লখনউ দেখ তুঝমে ধীরে ধীরে মর রহা হ্যায় লখনউ'

সেইদিন না চিনলেও আজ আমি জানি, এই ভদ্রলোকের নাম হল রাম আডবাণী। উইলিয়াম ডালরিম্পাল থেকে পল ব্রাস, রোজি-লিউন-জোন্স থেকে রামচন্দ্র গুহ, লখনউর ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছেন যারা, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। লখনউয়ের সাহিত্য-সংগীত-খাদ্য-সংস্কৃতির অন্যতম কদরদার তো বটেই, আওয়াধের ইতিহাস নিয়েও তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম। এই শহরের সংস্কৃতি ও আদবকায়দাকে জিইয়ে রাখার জন্য রাম আডবাণীর যে অবদান, তার কোনো তুলনা নেই। আডবাণী সাহেব আমাকে লখনউ সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি, বরং গরম সিঙাড়া আনিয়ে খাইয়েছিলেন মনে আছে। নিজে উদ্যোগ নিয়ে কয়েকটা বই বেছে দিয়েছিলেন। আবদুল হালিম শাহরের লেখা গুজিস্তা লখনউ আর ইয়োগেশ প্রবীণের লেখা 'দাস্তানে আওয়াধ' নিয়ে বেরোতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ভদ্রলোক দেরাজ খুলে আরো একটা বই এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, 'ইয়ে তোহলফা আপকে লিয়ে। লখনউকে জায়কে লজিজ হ্যায়, পর উসসে ভি লজি হ্যায় ইহা কে কিসসে। কিসসো কো জানে বিনা আপ ইহা কে জায়কো কা লুতফ নহি উঠা সকতে।'

শুক্রিয়া জানিয়ে দেখেছিলাম, বইটা পুরোনো। উর্দু থেকে হিন্দিতে অনূদিত। মির্জা জাফর হুস্যায়েনের লেখা স্মৃতিকথা ' লখনউ কা দাস্তারখান '। স্পষ্ট মনে আছে বইয়ের ভিতর একটা ম্যাপও ছিল।

এই তিনটে বই আমার কাছে লখনউকে নতুন করে মেলে ধরল। বিশেষ করে 'লখনউ কা দাস্তারখান' পড়ে আমি আওয়াধের রান্নাবান্না নিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। আডবাণী সাহেব ঠিকই বলেছিলেন, বইটা আসলে 'কিসসাগোই'-এর, আওয়াধের রান্নাবান্না নিয়ে বিবিধ গল্প বলে গিয়েছেন মির্জা জাফর স্যায়েন। বেদানার মতো দেখতে ক্ষীরের মিষ্টি, জ্যোৎস্নার আলোয় ঠাণ্ডা হওয়া পায়েস আর মালাই পানের কাহিনী জানলে যে কেউ কৌতূহলী হয়ে উঠবে! দিন গেল, সপ্তাহ গেল। সিনিয়ররা আমাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বন্ধুরা প্যাঁক দিল। ইলেক্ট্রনিক্সের মোটা মোটা বইকে মাথার বালিশ করে তখন আমি লখনউর বাবুর্চিদের চিত্তাকর্ষক 'কিসসা' পড়ে চলেছি। বুঝতেও পারলাম না কখন আমি অজান্তে এই শহরের ইতিহাস আর সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছি।

মাসখানেক যেতে না যেতেই আমার ছুটির দিনের রুটিন পুরোপুরি বদলে গেল। পুরোনো লখনউ তখন আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। সকাল সকাল হোস্টেল থেকে বেরিয়ে বাসে করে পৌঁছে যাই শহরের অপর প্রান্তে। এক এক দিন এক একটা পাড়া। কেসরবাগ, রাজাবাজার, হুস্যায়নাবাদ, নখখাস, ঠাকুরগঞ্জ, আমিনাবাদ... এবং চৌক। হাঁটতে থাকি জনবহুল রাস্তা ধরে। বুকপকেটে থাকত রাম আডবাণীর দেওয়া সেই ম্যাপ।

জায়কা-এ-আওয়াধ

সুদীপ চট্টোপাধ্যায়

 

বাঙালির পথঘাটের খাওয়া দাওয়া

সম্পাদনা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Bangalir Poth Ghater Khawa Dawa || Ardhendushekhar Goswami

SKU: 000142
₹590.00 Regular Price
₹472.00Sale Price
  • Book
    • বাঙালির পথঘাটের খাওয়া দাওয়া
    সম্পাদনা
    • অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
    Binding
    • Hardcover
    Publishing Date
    • 2023
    Publisher
    • Suprokash Publisher
    প্রচ্ছদ ও অলংকরণ      শোভন সরকার
    Language
    • Bengali

Related Products

bottom of page